স্বাধীনতার পর থেকে রাজ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বসবাসকারী আর্থিকভাবে অনগ্রসর শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়েছে। যার কারণে সংখ্যালঘু শ্রেণীভুক্ত জনগণের মধ্যে নিরক্ষরতার হার যথেষ্ট বেশি। তবে এখানেই শেষ নয় শিক্ষার অভাবে এই সকল সম্প্রদায়ভুক্ত জনগণের মধ্যে বাল্য বিবাহ থেকে শুরু করে স্কুল ছুট ছাত্র-ছাত্রী এবং শিশু শ্রমিকের সংখ্যাও যথেষ্ট বেশি। বিভিন্ন রিপোর্টে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে জানা গিয়েছে যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আর্থিক সমস্যার কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রসর হতে পারেন না। আর তাতেই সংখ্যালঘু শ্রেণীভুক্ত ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে পড়াশোনার ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে রাজ্য সরকারের তরফে বিভিন্ন প্রকারের প্রকল্প এবং স্কলারশিপ কার্যকর করা হয়েছে।
রাজ্য সরকারের তরফে কার্যকরী এই সমস্ত প্রকল্প এবং স্কলারশিপগুলির মধ্যে ঐক্যশ্রী স্কলারশিপটি সমগ্র রাজ্যের সংখ্যালঘু শ্রেণীভক্ত ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রাম্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী দরিদ্র অথচ মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে কোনরকম সমস্যা ছাড়াই পড়াশোনা করতে পারে এবং উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের তরফে ঐক্যশ্রী স্কলারশিপ কার্যকর করা হয়েছে। যদিও রাজ্য সরকারের এই স্কলারশিপটি অতি অল্প সময়ে রাজ্যের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
ঐক্যশ্রী স্কলারশিপের আওতায় কত টাকার অনুদান প্রদান করা হয়ে থাকে?
রাজ্য সরকারের তরফে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে জানা গিয়েছে যে, ঐক্যশ্রী স্কলারশিপের আওতায় আবেদনের প্রক্রিয়াটি এবং অনুদান প্রদানের প্রক্রিয়াটিকে সহজ করবার জন্য রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে স্কলারশিপটিকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তিনটি ভাগ হলো প্রি ম্যাট্রিক স্কলারশিপ, পোস্ট ম্যাট্রিক্স স্কলারশিপ, মেরিট কাম মিনস স্কলারশিপ।
প্রি ম্যাট্রিক স্কলারশিপের আওতায় প্রথম থেকে শুরু করে দশম শ্রেণীতে পাঠরত ছাত্র-ছাত্রীদের অনুদান প্রদান করা হয়ে থাকে। প্রি ম্যাট্রিক স্কলারশিপের আওতাধীন প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করে পঞ্চম শ্রেণীতে পাঠরত ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিবছরে ১১০০ টাকার অনুদান দেওয়া হয়ে। অন্যদিকে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে শুরু করে দশম শ্রেণীতে পাঠরত ছাত্রছাত্রীদের এই স্কলারশিপের আওতায় ৫৫০০ টাকার অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে। তবে এক্ষেত্রে যে সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছেন তাদের প্রত্যেক বছর ১১০০০ টাকার অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে।
একাদশ শ্রেণি থেকে শুরু করে পিএইচডি স্তরে পাঠরত ছাত্রছাত্রীরা পোস্ট ম্যাট্রিক স্কলারশিপের আওতায় অনুদান পেয়ে থাকে। এক্ষেত্রে একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণীতে পাঠরত ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতি বছরে ১০,২০০ টাকার অনুদান পাবেন। অন্যদিকে একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণীতে পাঠরত যে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীরা হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছেন তারা প্রত্যেক বছরে ১১৯০০ টাকার অনুদান পাবেন।
পোস্ট ম্যাট্রিক স্কলারশিপের আওতাধীন ভোকেশনাল এবং টেকনিক্যাল কোর্সের অধীনে যে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করছেন তারা প্রতিবছরে ১৩৫০০ টাকার অনুদান পাবেন। যে সকল ছাত্র-ছাত্রীরা হোস্টেলে থেকে ভোকেশনাল এবং টেকনিক্যাল কোর্সের অধীনে পড়াশোনা করছেন তারা প্রত্যেক বছরে ১৫,২০০ টাকার অনুদান পাবেন।
স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরে পাঠরত যে সকল ছাত্র-ছাত্রীরা পোস্ট ম্যাট্রিক স্কলারশিপের আওতায় নিজেদের নাম নথিভুক্ত করেছেন তারা প্রতিবছরে ৬৬০০ টাকার অনুদান পেয়ে যাবেন। হোস্টেলে থেকে যে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশোনা করছেন তাদের ৯৬০০ টাকার অনুদান দেওয়া হবে।
ঐক্যশ্রী স্কলারশিপের আওতাধীন পিএইচডি এবং এম. ফিল -এর অধীনস্থ ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতিবছরে ৯৩০০ টাকার অনুদান পাবেন এবং হোস্টেলের আবাসিক ছাত্র-ছাত্রীরা ১৬৫০০ টাকার অনুদান পাবেন।
ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেলের মতো প্রফেশনাল কোর্সের আওতাভুক্ত ছাত্র-ছাত্রীরা মেরিট কাম মিনস স্কলারশিপের অধীনে অনুদান পেয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রত্যেক বছরে ২৭,৫০০ টাকার অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে। অন্যদিকে যেসকল ছাত্র-ছাত্রীরা হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছেন তাদের প্রত্যেক বছরে ৩৩,০০০ টাকার অনুদান দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন:- রাজ্য সরকারের মানবিক প্রকল্পে আবেদন করুন এবং পেয়ে যান প্রতি মাসে ১০০০ টাকা
ঐক্যশ্রী স্কলারশিপের আওতায় আবেদনের ক্ষেত্রে আবশ্যিক যোগ্যতা:-
১. রাজ্য সরকারের প্রকাশিত তথ্য অনুসারে জানা গিয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী সংখ্যালঘু শ্রেণীভুক্ত ছাত্র-ছাত্রীরাই কেবলমাত্র ঐক্যশ্রী স্কলারশিপের আওতায় নিজেদের নাম নথিভুক্ত করতে পারবেন।
২. ঐক্যশ্রী স্কলারশিপের আওতায় আবেদনের ক্ষেত্রে আবেদনকারী ছাত্র অথবা ছাত্রীকে অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে।
৩. প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করে পিএইচডি স্তরে পাঠরত ছাত্রছাত্রীরা রাজ্য সরকারের তরফে কার্যকরী এই বিশেষ স্কলারশিপের আওতায় নিজেদের নাম নথিভুক্ত করতে পারবেন।
৪. যে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীরা পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের তরফে স্বীকৃত যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করছেন তারা এই স্কলারশিপের আওতায় আবেদন জানাতে পারবেন।
৫. প্রি ম্যাট্রিক এবং পোস্ট ম্যাট্রিক স্কলারশিপের আওতায় আবেদনের ক্ষেত্রে আবেদনকারী ছাত্র অথবা ছাত্রীর পরিবারের বাৎসরিক আয় ২ লক্ষ টাকা কিংবা তার চেয়ে কম হতে হবে। অন্যদিকে মেরিট কাম মিনস স্কলারশিপের আওতায় আবেদনের ক্ষেত্রে আবেদনকারী ছাত্র অথবা ছাত্রীর পরিবারের বাৎসরিক আয় ২,৫০,০০০ টাকার তুলনায় কম হতে হবে।
৬. যে সকল ছাত্র-ছাত্রীরা বিগত শ্রেণীর পরীক্ষায় ন্যূনতম ৫০% নম্বর পেয়েছেন তারাই কেবলমাত্র ঐক্যশ্রী স্কলারশিপের আওতায় আবেদনের যোগ্য হলে বিবেচিত হবেন।
৭. একজন ছাত্র অথবা ছাত্রী কেবলমাত্র একটি মোবাইল নম্বরের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশনের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে পারবেন।
৮. ঐক্যশ্রী স্কলারশিপের আওতায় আবেদনের ক্ষেত্রে আবেদনকারী শিক্ষার্থীর নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকা আবশ্যক। তবে প্রি ম্যাট্রিক স্কলারশিপের আওতাধীন ছাত্রছাত্রীরা পিতা-মাতা অথবা অভিভাবকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে আবেদন জানাতে পারবেন।
৯. একজন শিক্ষার্থী একটি মাত্র স্কলারশিপের জন্য আবেদন জানাতে পারবেন। অর্থাৎ অন্য কোন সরকারি অথবা বেসরকারি স্কলারশিপের আওতায় অনুদানের টাকা পেলে ঐক্যশ্রী স্কলারশিপের আওতায় আবেদন করা যাবে না।
আবেদনের প্রক্রিয়া:-
ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধার খাতিরে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের তরফে ঐক্যশ্রী স্কলারশিপের আওতায় নাম নথিভুক্ত করার জন্য এক বিশেষ ওয়েবসাইট কার্যকর করা হয়েছে। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমেই রাজ্যে ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের নাম নথিভুক্ত করতে পারবেন। সুতরাং আপনিও যদি ঐক্যশ্রী স্কলারশিপের আওতায় নিজের নাম নথিভুক্ত করতে চান তবে আপনাকেও ঐক্যশ্রী স্কলারশিপের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট wbmdfcscholarship.org -এ যেতে হবে। পরবর্তীতে আপনার সামনে যে পেজটি আসবে তাতে থাকা অপশনগুলির মধ্যে থেকে আপনাকে Student’s Area অপশনটি নির্বাচন করে নিতে হবে। পরবর্তীতে আপনার সামনে আসা পেজটিতে থাকা অপশনগুলির মধ্যে থেকে আপনাকে Fresh Registration 2022-2023 অপশনটি বেছে নিতে হবে। এরপর আপনার সামনে যে পেজটি আসবে তাতে আপনি পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জেলাগুলির নাম দেখতে পাবেন। এর মধ্যে থেকে আপনাকে আপনার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যে জেলায় অবস্থিত সেই জেলাটির নাম নির্বাচন করে নিতে হবে এবং Ok অপশনে ক্লিক করতে হবে।
পরবর্তীতে আপনার সামনে যে পেজটি আসবে তাতে আপনাকে আবেদনকারীর রাজ্য, জেলা, ব্লক অথবা মিউনিসিপ্যালিটি, গ্রাম পঞ্চায়েতের নাম, ছাত্র অথবা ছাত্রীর নাম, পিতার নাম, মাতার নাম, ধর্ম, লিঙ্গ, জন্মতারিখ, মোবাইল নম্বর, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর, IFSC কোড সঠিকভাবে লিখতে হবে এবং উক্ত পেজের একেবারে নিচে থাকা আর ক্যাপচা কোডটি সঠিকভাবে পূরণ করে SUBMIT AND PROCEED অপশনে ক্লিক করতে হবে। এরপর আবেদানকারী ছাত্র অথবা ছাত্রী যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেন তার নাম, আবেদনকারী কোন কোর্সে পড়াশোনা করছেন, বর্তমানে কোন ক্লাসে পড়াশোনা করছেন, শেষ পরীক্ষার নাম, কোন বোর্ড থেকে শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, কত সালে শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, কত শতাংশ নম্বরে উত্তীর্ণ হয়েছেন, পরিবারের বাৎসরিক আয় এবং ইমেইল আইডি সঠিকভাবে প্রদান করতে হবে।
উপরোক্ত তথ্যগুলি সঠিকভাবে প্রদান করার পর আবেদনকারী ছাত্র অথবা ছাত্রীর পছন্দ অনুসারে একটি পাসওয়ার্ড নির্বাচন করতে হবে এবং SUBMIT AND PROCEED অপশনে ক্লিক করতে হবে। এরপর Continue অপশনে ক্লিক করতে হবে। উপরোক্ত অপশনে ক্লিক করলে আপনার রেজিস্ট্রেশনের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে এবং আপনার ফোন অথবা কম্পিউটারের স্ক্রিনে অ্যাপ্লিকেশন আইডিটি চলে আসবে। পরবর্তী সময়ের জন্য এই আইডিটি সংগ্রহ করে রাখতে হবে।
রেজিস্ট্রেশনের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হলে আপনাকে আপনার অ্যাপ্লিকেশন আইডি এবং পাসওয়ার্ড -এর মাধ্যমে লগইনের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে হবে। লগইনের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হলে আপনার সামনে যে নতুন পেজটি আসবে তার একেবারে বাঁদিকে থাকা ড্যাশবোর্ডের BASIC INFORMATION অপশনে আপনাকে ক্লিক করতে হবে এবং পরবর্তীতে আপনার সামনে যে পেজটি আসবে তাতে আবেদনকারীর ঠিকানা, বৈবাহিক স্থিতি এবং আধার কার্ড সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য প্রদান করে SUBMIT And Proceed অপশনে ক্লিক করতে হবে। এরপর আপনার সামনে আসা নতুন পেজটিতে আপনার পূর্ববর্তী বিদ্যা প্রতিষ্ঠান এবং বর্তমানে আপনি যে বিদ্যা প্রতিষ্ঠানে পাঠরত তার সমস্ত তথ্য সঠিকভাবে উল্লেখ করতে হবে। সমস্ত তথ্য নির্ভুলভাবে পূরণ করার পর SUBMIT And Proceed অপশনে ক্লিক করতে হবে।
সবশেষে আপনাকে আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সমস্ত তথ্য সঠিকভাবে প্রদান করার মাধ্যমে আবেদনের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে হবে। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সমস্ত তথ্য প্রদান করার পর আপনাকে পুনরায় SUBMIT And Proceed অপশনে ক্লিক করতে হবে। এর পরবর্তীতে আপনার সামনে সমগ্র ফর্মটির একটি প্রিভিউ আসবে। এক্ষেত্রে সমস্ত তথ্য সঠিক থাকলে Verify and Lock application অপশনে ক্লিক করতে হবে। উপরোক্ত প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করলেই ঐক্যশ্রী স্কলারশিপের জন্য আবেদনের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে।
আবেদনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নথি:-
১. পূর্ববর্তী পরীক্ষার মার্কশীট।
২. ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সমস্ত তথ্য।
৩. আবেদনকারী শিক্ষার্থীর পরিবারের বাৎসরিক আয়ের সার্টিফিকেট।
৪. ইনস্টিটিউশন ভেরিফিকেশন ফর্ম।
৫. আধার কার্ড।
৬. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির রশিদ।
৭. সমগ্র কোর্সের খরচের লিস্ট।